সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আমি হাত রেখে একজন বিদায়ী পথের শূন্য অভিযাত্রীর হাতে

বাজার করতে যাওয়াটা ভয়াবহ একটা ঝামেলা তাই না? আপনার কি মনে হয়? তাও যদি হয় বৃষ্টি শেষ হওয়ার পর এক গোড়ালী কাঁদার মধ্যে তাহলে তো সোনায় সোহাগা। বেশ ফুরফুরে মনে জুতোর তলায় কালো আঠালো কাঁদার আন্তরিকতা সাথে নিয়ে কাঁচা বাজারে প্রবেশ বৃত্ত সাহেবের।

মানে এই আমিটা যখন বাজারে ঢুকলাম চার বছর আগের সেই নিয়মিত পসরা সাজানো সব্জিওয়ালাদেরকে দেখছিলামনা। খুজে যাচ্ছিলাম ঢুকার পথেই দক্ষিন পার্শের পানির টেপটার ঠিক ২ হাত সামনে যে শেষ গোধুলির মানুষটা বসতো তাঁকে। নেই-- তবে জায়গা টা শুন্য নয়। যুবক বয়সী একই চেহারার আরেকজন সেই একই ডালা নিয়ে বসে আছে। সেই চেনা হাসি যা তার বাবার মুখে ছিলো। কালের পরিক্রমায় কোথায় হারিয়ে গেলো সেই চেনা মুখ। ডান পার্শের নও জোয়ান ছেলেটি বেশ পরিপক্ক হয়েছে বলেই মনে হলো।

আমাকে বলেঃ আসসালামু আলাইকুম। কবে আইছেন? তার শব্জিতে পানি ছিটানো ভেজা হাতে হ্যান্ডশেক করতে আমার হাত এগিয়ে দিয়েই বলি গতকাল আইছি। আপনি কেমন আছেন? বাড়িতে সবাই ভালোতো?

আত্মতৃপ্তির একটা চোখবোজা দেখে মনে হলো লোকটা ভাবছে যাক- ভোলেনাই আমাগোরে- আইজকাইল তো সবাই ভুইলা যায়। জ্বি আছে সবাই ভালা। আপনের বাড়িতে আছে ভালো সবে? জ্বি ভালো- দোয়া করবেন-----

হনি পাগলীকে এখানে দেখেছিলাম ছোট বেলা থেকে। কি'জানি কোন অজানা দূঃখ বোধ থেকে সে কেবল হেসেই যেতো। অসচেতন ভাবে সকল সময়েই তার মাতৃত্ত্ব গুলো উন্মুক্ত থাকতো। সবাইকে অবাক করা মায়ায় জড়িয়ে রাখতো এই পাগলী। কেউ কিছু দিলে খেতো না দিলে নেই। অনেক সুখি একটা মানুষ। দেখা হয়ে গেলো ওর সাথেও-- আমাকে দেখে দাত বের করে বেশ লম্বা একটা হাসি দিলো... পেছনে আটকা পড়া বুড়ো চাচা আন্তরিক স্বরে বলছিলো হনী সর-- একটু সরে দাড়া, আমাকে যেতে দে- হনি তার দিকে আরো জোরে একটি হাসি দিয়ে সরে দাড়ায়-- মেয়েটা হয়তো কোনো এক কালে কারো বৌ ছিলো... আচ্ছা তার কি কোনো প্রেমিক ছিলো? লোকটা তাকে ভালোবাসতো?

--ক্রেতাদের ভিরে নিজেকে আবার ধিরে মিশিয়ে নেই--

চেয়ালে দাঁতের অনুপস্থিতির কারনে কুঁচকানো শ্যামলা বিবর্ণ চামড়া মাড়ির সাথে অনেক আদরনীয় ভাবে লেগে আছে--- বয়সের আঘাতে চোখগুলো স্ব স্ব স্থানে অনেক বেশী কোটরাগত হয়ে পড়েছে। সবুজ অঞ্চলের খয়ড়ী পেড়ে সেই সস্তা দেড় বছরের পুরোনো শাড়ী পড়ে কালেমা খালা ( খুব পরিচিত একটি ভুখারী মুখ) সেই আন্তরিক ফোকলা হাসি দিয়ে আমাকে বলে ভায়া-- কেমন আছেন? আমি তার হাড়ের উপর পাতলা পিচ্ছিল চামড়ায় সাজানো হাতে নিজের হাতটাকে জড়িয়ে নিয়ে বললামঃ ভালো খালা-- তুমি কেমন আছো? অভাবী বেশ উচ্ছল কম্পমান ৮০ বছরের ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলে ওঠে আল্লায় রাখছে বাবা।

পাশে ছোট ভাইকে দেখিয়ে জানতে চায় এটা কে? আমি বললাম ও আমার ছোট ভাই। জানার সাথে সাথেই ওর মাথায় গায় হাত বুলিয়ে সে'কি দোয়া করতে লাগলেন। দীর্ঘ সময় দোয়া করার পর আমি বললাম খালা তোমার পোলা মায়ার কি খবর? বেশ সক্তিশালী কানে খালা সব শুনতে পায়। একটা ছোট্ট দম নিয়ে বলে-- বাবা একটাই তো মায়া আছিলো। ওরে তো হেই কবেই বিয়া দিয়া দিছি। এখন একাই থাকি ঘরে। আমি অবাক হয়ে ভাবি-- এই বয়সে এই বিদগ্ধ নারী একা রাত্রীর সময়গুলো কাটায়। উনি চোখ বন্ধ করলে কি দেখেন? তার কাছে পুরো জীবনটা কি ছায়া ছবির মতো একটি মূহুর্ত মনে হয়না? আসলে জীবনের দৈর্ঘ কতটুকু? ৮০ বছর নাকি এই মূহুর্তটুকু?

বেশ শক্ত করের কালেমা খালার পিতলের ক্ষয়ে যাওয়া চুড়ির স্পর্শে গভীর রেখা নিয়ে দৃশ্যমান রগগুলোর উপস্থতি সমৃদ্ধ হাতটাকে জড়িয়ে ধরে আছি-- যেনো এটাই আমার অনেক মূল্যবান কোনো সম্পদ। খালা বলে যায়-- বাবা কত কিছু খাইতে মনচায়-- আমার কন্ঠে অনেক পানি জমেছে-টের পাচ্ছি। ভেজা কন্ঠে জানতে চাই -- কি খাইতে মনচায় খালা?

মিষ্টি, মুরগীর গোস্ত, গরু-- আরো কিছু ভালা ভালা খাওন। এই যে শাড়ীটা আছে এইটার বয়স দেড় বছর------ ধিরে খালার কন্ঠস্বর আমার কাছে ঘোলাটে মনে হতে থাকে। আমি কেমন যেনো প্রতিদ্ধনিত ভাবে শুনতে পাচ্ছি সব কিছু-- এই বিশাল শপিং কমপ্লেক্সে ঠিক মধ্যখানে আমি সময়ের এক বিস্তর স্বাক্ষীর হাতে হাত রেখে দাড়িয়ে। সবার ব্যাস্ততা দেখে দেখে ক্লান্ত দুচোখে অনেক রঙের ছুটোছুটি। ঈদের ক্রেতাদের কোলাহল- সব চাওয়া পাওয়া হবার পরও পাল্লা ...কে কার চেয়ে দামীটা কিনবে--- এইসব ঘিরে আমাকে---

আমি হাত রেখে একজন বিদায়ী পথের শূন্য অভিযাত্রীর হাতে---যার এখনো অগনন চাওয়া অপূর্ণ।

১২টা ১৯মি। ০৯/০৯/১০

http://sonarbangladesh.com/blog/lalbritto/5866

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুদুর চোখে সমুদ্র

প্রায় প্রতিদিনের মতই আজো ত্রস্তপায় সন্ধ্যারা ভীত ক্লান্ত গার্মেন্ট শ্রমিক হাছিনার ব্যাথায় কাতর হাটুর উপর ভর করে পৃথিবীর বুকে নেমে এলো। পৃথিবীর কি আসলে বুক আছে? উহু!! তাতো থাকার কথা নয়। সবটাই পিঠ। বলা উচিৎ পৃথিবীর পিঠে নেমে এলো। সাধারনত আমরা পিঠটাকে আবার কোল বলতে পছন্দ করি। সাহিত্যিক একটা ভাব নিয়ে বলা যায় ক্লান্তিকর বিরক্তভরা অন্ধকার তার গাঢ় নীল রঙএ লাশের গায় জড়ানো শেষ কাপড়গুলোর মত পৃথিবীর কোলকে আবৃত কছে। এইসব উলটাপালটা ভাবতে ভাবতে জানালা দিয়ে রাত্রীর ভয়াবহ আগমনে পলায়নপর সূর্যের শেষ উঁকিঝুকি দেখে জীবন সায়াহ্নে অলস দিনগুলো কাটাচ্ছে মাহমুদ। ধিরে পরিচিত সব বিদায় নিচ্ছে। কিছুদিন হলো ঘাসফরিং উড়ে গেছে, তার আগে বৃষ্টিরদাগ ধুয়ে মুছে গেছে পৃথিবীর কোল থেকে। বিদ্রোহী প্রাণ নিভু নিভু করে খুব নিচু স্বরে তার নাতনীর সাহায্যে মোবাইলে বিড়বিড় করে অস্পষ্ট স্বরে। ওদিকে নষ্টালজিকের চুল পেঁকে বুড়ো। তারিক, শিহান সবার বুঝি সন্ধ্যা ঘনালো। একসময় এই রঙ্গীন জগতের সব রঙই চোখে ধুসর হয়ে ধরা দেয়। কিন্তু তখন আসলে কোন চশমা লাগিয়েও জগতের রঙ গুলোকে ফ্যাকাশে হওয়া থেকে নিস্তার দেয়া যায় না। ওটাই আসলে ধারিত্রীর র

নামাজি কাজ ফেলিয়া

আজ নামাজি কাজ ফেলিয়া ছুটিছে দেখ সিজদাতে, এমনি করে জগত ভরে হোক জমায়েত রোজ রাতে। খোদার ঘরে দরুদ পরে হাজার হাজার মুসলমান; দোর খোলা দিল পথ ভোলা দিল সবমিলে আজ উজাড় প্রাণ। হয় মুসাফির বছর ভুলে আজ কেবলি ঝুকলো শির। কেমন করে আঙ্গুল তোল? তুমিই কে বা মহান পীর? খোদার কাছে কাঁদল অবুঝ কাঁদল পাপী, কদরদান। কান্নাটা তো আসল ছিল, হোক না সে খুব অচলপ্রাণ! এইচ আল বান্না © 2017

হাল ছেড়ে দিলে বন্ধু??

হাল ছেড়ে দিলে বন্ধু?? জীবনকি এভাবেই তোমাকে বহমান স্রোতধারায় ভাসিয়ে নিজ়ে যাবে?? আজ কোনো কঠিন শব্দ গুচ্ছ আমাকে আক্রমন করেনা... আমি নিজেই আপন ব্যাথায় আহত... বুকের কোথাও খেজুর কাঁটার খোঁচার মতো তীক্ষ্ণ ব্যাথা ধীরে প্রশস্ত অবয়ব নেয়... নিয়ে নেয় একাই পর্যদুস্ত... পরাজিত হয়ে গেলে তুমি?? তুমি না বিজয় শেখাও??? তুমি না আকাশকে পকেটে পুরে মেঘের হাওয়াই মিঠাই আপন মুখে আপন সুখে সুখ মেলাও!! দেখবে কোথায় আকাশ লুকায় কান্না ঝড়ায় পাহাড় গায়ে নয়তো কোথাও বিষন্নতাও ডুকরে কাঁদে মাঝির নায়ে একটু ধারে জীবন পারে কোন বেহালা বাদক বসে... ভেজায় তাহার আপন সুরে এক অবেলার দূঃখ রসে? উত্থান পতনের ক্রমাগত আঘাতে বেসামাল জীবন তোমার... আমিও ভাবি... হয়তো বেশী দিন নেই, আমার দুখের পাপড়ি ভাঙ্গার... অনেক সুখেই কাটছে আমার দিন প্রতিক্ষন সন্ধ্যা লগন... একজনাকেই সব শপেছি... প্রার্থনাতে তাই জপেছি... অনেক কষ্ট আর বেদনা নিয়ে তুমি পালিয়ে যাবে?? তিনিকি এর চেয়েও বেশী কষ্ট কাউকে দেননি?? পরীক্ষা করেননি?? হাল ছেড়ে দিলে বন্ধু??