|
আমি যখন রস্তার মাঝ বরাবর রোড ডিভাইডারকে বামে রেখে হেটে আসছিলাম ওরা বললো আজও ওরা আসবে। দূর থেকে ব্যাস্ত ঈদের ক্রেতারা সুখ কেনে ঘরে ফেরার আগে এমন একটি দৃশ্য দেখে আর একবার ঘুরে তাকায়। রিক্সাওয়ালা কাঁধে ফেলা গামছা হাতে নিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে তাকিয়ে থাকে----আমি অবচেতনে টের পাই অনেকগুলো চোখ আমাকে অনুসরন করছে। আমার সম্মুখে সেই দিঘল রাঙ্গা কেশ। সামনের দাতগুলোতে পানের শক্ত রঙ। ঠোট লাল। মুগ্ধ মনে সত্যিকারের একটা অঞ্চল। যেখানে আমাদের মতো কোনো কৃত্তিমতা নেই- নেই মুখোশ। চিকন চিকন শলাকার ন্যায় অপুষ্ট হাতগুলোতে পৃথিবী আগলানোর মতো অসীম জোর।
গতকাল ওরা আমার আঙ্গীনায় এসেছিলো। আমি না থাকলে হয়তো শাহানামা ভাই (গেইটম্যান) ওদেরকে তাড়িয়ে দিতো। কিন্তু আমি থাকায় আড় চোখে বার কয়েক আমার মনের অবস্থা বুঝার চেষ্টা করে ওদের মায়ায় জড়িয়ে পরেন। উচ্ছল প্রাণগুলো এসেই হাবুডুবু খেলা শুরু করলো। আরে--- ভুলে গেলাম। আমার এখানে একটা খেলনা আছে কি নাম যেনো। ধুত্তুরি। মনে পড়ছেনা। ঐযে একজন এক পাশে আরেকজন অন্যপাশে। এপাশ উচু হলে ওপাশ নিচু হয়—ওপাশ উচু হলে এপাশ নিচু হয়। হুরুমুরু করে এসে ঝটিকা বেগে খেলা শুরু করে দিলো। কিছুক্ষণ পরই শুরু হলো কানামাছি। সানি, প্রিয়া, সাথী, মিশু, সোনিয়া।
অদ্ভুত এই প্রাণের খেলা দেখে নিজেকে ওদের দলে নিয়ে যাওয়ার লোভটা সংবরন করতে পারলামনা। পরম আদরে বললাম আমিও খেলবো তোমাদের সাথে। প্রিয়া, মিশু, সোনিয়া রাজী হলোনা। এমন বুড়ো একটা মানুষকে কে নেবে? কিন্তু সানি, সাথি বলে থাক স্যার খেলুক। কানামাছিতে নাম প্রয়োজন হয়। আপনার নাম কি? আমি বললাম ভাইয়া। আমাকে অবাক করে নিয়ে নিলো খেলায়। প্রথমবারেই আমি কানা হলাম। তো সাথীর পুরোনো চিটচিটে ওড়না দিয়ে আমার চোখ বেঁধে দিলো।
হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করছি মাছিদের। ছুটতে ছুটতে রাস্তার ধারে চলে গেলে সাথী সাবধান করে দেয় ভাইয়া রাস্তায় চলে এসেছেন। ধরে ফেললাম একজনকে। অনেক চেষ্টা করলো ছুটে যাওয়ার। কিন্তু কাজ হলোনা। ওরা জিজ্ঞেস করছে কে? কারন নাম তো বলতে হবে কাকে ধরলাম। আমার তো নাম মুখস্ত নেই। ওরাই নিজ থেকে বলে দিলো সোনিয়া।সোনিয়া। এর পর সোনিয়া কানা। আর আমরা সব মাছি----- খেলতে গিয়ে কানার হাত থেকে পেছনে পালাতে পড়ে গেলাম। হাতের তালুতে আঘাত লাগায় ব্যথা করছিলো। কিন্তু ব্যথাটকেও কেনো যেনো অনেক মধুর মনে হচ্ছিলো। এভাবে অনেক আনন্দ মুখর সময় পিছু চলেছিলো আমাদের।
রাস্তার সোডিয়ামের আলোয় এই জ্বোনাকীগুলোকে বড় বেশী উজ্জ্বল লাগছিলো। আচমকা সাথির চকচকে হাতে আলোর ঝিলিক দেখে অবাক হলাম। জানতে চাইলাম কি হয়েছে? সাথী জবাব দেয় পুড়ে গিয়েছিলো। মাথার উস্কোখুস্কো চুলগুলো অযত্ন আর অবহেলার বিষন্ন সাক্ষী হয়ে আমাদের সাথে উপহাস খেলে যাচ্ছে। আমি ধির গভীর ভাবনা যুক্ত চোখে দেখে যাই তাদের ভেতরে বসবাস করা মানুষগুলোর রূপ-
অবশেষে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লাম। শুরু হলো গান। নানান কিসিমের গান গেয়ে চলছে- হিন্দী বাংলা- তবে গানগুলোর অধিকাংশের ভাষাই অনেকটা গুরুতর অসুস্থ্য। ওরা তো বুঝতে পারছিলোনা ওরা কি গাইছে। এভাবেই অবচেতনে কিছু বিষ আমাদের শিশুদের মনে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমি ভেবে পাচ্ছিলামনা। ওরা কেবলি বড়দের গান গাচ্ছে। যেগুলো ওদের সাথে একেবারেই বেমানান। জিজ্ঞেস করলাম আমরা করবো জয় এটা পারো? মাথাকে সুন্দর ডানে বামে ঘুরিয়ে দিলো। ফিল্টারে পানি খেতে এসে প্রিয়া দেয়ালে ঝুলানো কালো ঘড়িটায় নজর দিয়ে দেখলো দশটা বাঁজে তখন তাদের খেয়াল হলো ফিরে যেতে হবে সেই খুপড়িতে। যেখানে মা আর ছোট ভাই কুপির কাঁপা লাল আলোয় তার অপেক্ষায়।
সুন্দর কিছু হাসি উপহার দিয়ে এতক্ষনের উজ্জ্বল আর উচছল সময়ের প্রাংগন ছেড়ে আবার ওরা ফিরে যাচ্ছে স্বপ্নহীন জীবনের বিদগ্ধ কুটিরে। উন্মুক্ত কাঁধে আবার উঠে আসে প্লাষ্টিকের সাদা বস্তাগুলো। ওরা যাচ্ছে। সাথে নিয়ে যাচ্ছে আমার স্বপ্নীল চোখের বর্ণীল কিছু অধ্যায়। ধিরে দৃষ্টির আড়াল হয়ে যায় অন্ধকারের জ্বোনাকিরা।
আজ বৃষ্টি আসতে চাইছে বোধহয়। এইচ এম প্লাজার সামনে সিঁড়ির গোড়ায় আগুনে ঝলসে যাওয়া একটি পোড়া উন্মুক্ত হাড্ডীসাড় শরীর, পাশে লাল প্লাষ্টিকের বাটি। কিছু ছেঁড়া দুটাকার নোট, একটা পাঁচটাকা আর কয়েকটি খুচড়া পয়সা। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে—সাথী—আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি।এই পোড়া শরীর নিয়েও তার কত আনন্দ...গতকাল সন্ধ্যায় আমার সাথে খেলেছে- গান গেয়েছে। তখন অবশ্য তার শরীরটা দেখা যায়নি। চোখ খুললেই দেখতে পেতো তার ভাইয়া তাকিয়ে আছে এক বুক মায়া নিয়ে। কিন্তু এই ভাই তার এতোটা অসহায় যে নিজের সামর্থ নেই বলে কিছুই করতে পারছেনা। এই সব দূঃখ বোধ আর দ্বায়বদ্ধতা লাঘব করতেই হেসে খেলে যাই তোদের সাথে। পারলে ক্ষমা করিস।
বাসায় ফেরার পথে সনির সাথে দেখা। কাঁধে ঝোলা ঝুলছে। ভাইয়া কেমন আছেন? আমি তাকিয়েই থাকি ওর সুন্দর মুখের দিকে। ভালো। তোমরা কেমন? ভালো নাই ভাইয়া- ঐযে ডাক্তার ঘর (ক্লিনিক) আছেনা? ওটার পাশে দুইটা ড্রাম। ওটার একটার মধ্যে কে যেনো একটা বাচ্চা মাইরা ফালায়া রাইখা গেছে। আহারে বাচ্চাটার চোখ ফোটেনাই এখনো। আমার ভেতরে অসহ্য একটা যন্ত্রণা মাথা থেকে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল পর্যন্ত বিদ্যুত স্ফুলিঙ্গের ন্যায় বয়ে চলছে।
অসহায় চোখে তাকিয়ে সানি বলছেঃ ভাইয়া আপনের পায় ধরি ঐ বাচ্চাটারে কবর দেয়ার ব্যাবস্থা করেন। অসহনীয় সমিকরনে জীবনের সামনে দাড়িয়ে আমি কথা হাড়িয়ে ফেলি। চোখের অশ্রুগুলো অনেক দিন আগেই শুকিয়ে গেছে। সবাই যেখানে সোনিয়াদেরকে মানুষ ভাবছেনা সেখানে তারা একটি লাশকে মানব সম্মানে দাফন করতে বলছে। কি অদ্ভুত!!
সেদিন এগারো নম্বর যাওয়ার পথে সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মীকে দেখেছিলাম অনেক কসরত করছে মাছিদের আক্রমনে আক্রান্ত একটি মরা কুকুরকে ময়ালার গাড়িতে তুলতে। লোকটি গাড়ির নোংড়া ময়লার মধ্যে দাড়িয়ে একটি কাগজে পেচিয়ে লাশটির সামনের পা ধরে টানছে—কিন্তু কুলিয়ে উঠতে পারছিলেননা। আমার ভেতরের একটা মন বলছিলো তাকে সাহায্য করা দরকার। সাথে সাথে অন্যটা ধমক দিয়ে বলে এতো মানুষ চারিদিকে- কি বলবে সবাই? এমন স্মার্ট ভদ্র একটা মানুষ যদি এভাবে মরা কুকুরের লাশ তুলতে যায় তাহলে এটা কেমন দেখায়? তুই কি গাধা নাকি? শেষ পর্যন্ত ও ই জিতে গেলো।
আজ অনেক বার ভাবনাকে দূরে ঠেলে দিতে চাইলেও ভেসে উঠলো চোখে ফের কসরত করছে সেই পরিচ্ছন্নতা কর্মী—ময়লার গাড়িতেই তুলছেন একটি লাশ। তবে কোনো কুকুরের নয়। দুজন মানব মানবীর ফসল- একটি ফুটফুটে মানব সন্তান।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন